ভারত উপমহাদেশে আদিবাসীদের মুক্তির জন্য যুগে যুগে যত মহান নেতা অবতীর্ন হয়েছেন তাদের মধ্যে বিরসা মুন্ডা অন্যতম। তিনি ব্রিটিশদের দীর্ঘকালের অত্যাচার, নিপীড়ন এবং দাসাত্বতা থেকে মুন্ডাদের শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। লক্ষ লক্ষ মুন্ডা তাকে অনুসরন করে মুক্তির আশা বুকে ধারণ করেছিলেন। বিরসা মুন্ডা বুঝতে পেরেছিলেন যে ব্রিটিশরা মুন্ডাদেরকে শোষণ করতে আসছে, মুন্ডাদের সম্পদ লুঠন করে বিদেশে নিয়ে যাবে। এজন্য তিনি মুন্ডাদের মুক্তির পথপ্রদর্শক হিসেবে আবির্ভূত হন। ভারতীয় উপমহাদেশে ঊনিশ শতকের শেষের দিকে আদিবাসীদের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা সোচ্চার হতে থাকে। ছোটনাগপুর অঞ্চলে তিনি অত্যাচারিত এবং অপদস্ত মুন্ডা আদিবাসীদের বিদ্রোহী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন ভারতের রাঁচি অঞ্চলের একজন মুন্ডা আদিবাসীনেতা সমাজ সংস্কারক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার-অবিচারের ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি আদিবাসী মুন্ডাদের সংগঠিত করে মুন্ডা বিদ্রোহের সূচনা করেন। বিদ্রোহীদের কাছে তিনি ‘বিরসা ভগবান’ নামেও পরিচিত ছিলেন।
Birsa Munda
তিনি মুন্ডা জনগোষ্ঠীকে ইংরেজদের থেকে মুক্তি পাওয়ানোর জন্য নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। ১৮৯৪ সালে মানভূমের ছোটনাগপুরে কৃষি উৎপাদন বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে মারাত্মক আকাল ও মহামারী ছড়িয়ে ছিল। বিরসা পুরো মনোযোগ দিয়ে নিজেদের লোকেদের সেবা করেছিল। ১লা অক্টোবর ১৮৯৪ সালে যুবক নেতা রূপে সব মুন্ডাদের একত্র করে ইনি ইংরেজদের থেকে কর ক্ষমা করে দেওয়ার আন্দোলন করেছিলেন। এটিকে অপরাধ হিসাবে ধরে ১৮৯৫ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ও হাজারীবাগ কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই বছরের কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিরসা মুন্ডা ও তার শিষ্যরা এলাকার আকাল পীড়িত জনতাদের সাহায্য করবে তা নির্ধারিত করে নিয়েছিল আর নিজের জীবনকালে তিনি মহাপুরুষের মর্যাদা পেয়েছিলেন। মহাযোদ্ধা বিরসা মুন্ডা ঊনিশ শতকের একজন প্রমুখ আদিবাসী জননায়ক ছিলেন। ওনার নেতৃত্বে আদিবাসীরা ঊনিশ শতকের শেষ বছরে মহান আন্দোলন দ্বারা ব্রিটিশ সরকারের ভীতকে নড়িয়ে দিয়েছিল। বিরসা মুন্ডাকে শুধু আদিবাসী সমাজ নয়, পুরো ভারতের রাষ্ট্রবাদী জনগণ একজন ভগবান হিসাবে পূজা করে কারণ সেসময় মনে করা হত কামান কে তীর দিয়ে শান্ত করার যুদ্ধ কৌশল সেসময় শুধু দেবতা ও বিরসা মুন্ডারই ছিল।
Munda Movement
বিরসাকে এলাকার লোকেরা ‘ধারটি বাবা’ এই নামে ডাকত ও পুজো করত। তার নেতৃত্বের প্রভাব বৃদ্ধির পর পুরো এলাকায় মুন্ডাদের মধ্যে সাংগঠনিক জোয়ার এসেছিল। ১৮৯৭-১৯০০’র মধ্যে মুন্ডা ও ইংরেজ সিপাহিদের মধ্যে বারংবার যুদ্ধ হতে থাকে ও তাঁরা ইংরেজদের জ্বালিয়ে মারছিল। আগস্ট ১৮৯৭ সালে বিরসা মুন্ডা ও চারশো দেশ ভক্ত ক্রান্তিকারী সিপাহীরা তিনটি কামান দ্বারা সজ্জিত হয়ে খুঁটি থানায় ধাবা দিয়েছিল। ১৮৯৮ সালে নাগা নদীর ধারে মুণ্ডাদের লড়াই ইংরেজ সেনাদের সঙ্গে হয়েছিল, যাতে ইংরেজ সেনারা প্রথমে তো মুণ্ডাদের কাছে হেরে যায় কিন্তু পরে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মুন্ডারা হারতে শুরু করে। ওই এলাকার বহু আদিবাসীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই গ্রেপ্তারকারী লোকেদের মধ্যে সেই সব বেইমান হিন্দুস্তানি সিপাহীরা ছিল যারা মেডেল ও বেতনের জন্য নিজেদেরই দেশের লোকেদের উপর গুলি চালাচ্ছিলেন।
বিরসা মুন্ডা আদিবাসী মুন্ডা জনগোষ্ঠীদের জমিদারী, মিশনারী এবং বৃটিশ শাষকদের শোষন-নীপিড়ন এবং জিম্মীর হাত হতে রক্ষার জন্য আন্দোলন করেন এবং মুন্ডা জনগোষ্ঠীর লোকজন বিরসার নতুন ধর্মমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ‘বিরসাইত’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। ২৪ ডিসেম্বর ১৮৯৯ সালে বিরসা মুন্ডা তাঁর বিরসাইতদের নিয়ে শোষন বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম আক্রমন করেন মিশনগুলোতে। আগুন জ্বলতে থাকে সমস্ত এলাকায়। এ সময় বেশ কিছু ইংরেজ সাহেব, মিশনারী সাহেব, পুলিশ, চৌকিদার আহত এবং নিহত হন। বিরসার এই আক্রমনে ইংরেজ গোষ্ঠী নড়েচড়ে বসেন এবং বিরসার বিদ্রোহ দমনের জন্য সাঁড়াশি অভিযান চালান। কিছুদিন আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় জানুয়ারি ১৯০০ সালে ডোমবারি পাহাড়ে আরেকটি সংঘর্ষ করেন, যেখানে অনেক মহিলা ও বাচ্চারা ইংরেজের গুলিতে মারা গিয়েছিল কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ইতিহাসে কখনো ওই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করা হয়নি, বিশেষ করে ওনাদের দ্বারা যে দিন রাত গো-রক্ষকদের উপর নজর লাগিয়ে বসে থাকতো ও তাদের গুন্ডা বানানোর একটিও সুযোগ ছাড়তো না, ওই জায়গায় বিরসা মুন্ডা নিজের জনসভায় সম্ভাষণ করছিল। ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০০ সালে ইংরেজ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন বিদ্রোহের পরে বিরসাসহ তাঁর শতাধিক সঙ্গী গ্রেপ্তার হন। পরে বিরসা মুন্ডার আরোকিছু শিষ্যও গ্রেপ্তার হয়। জেলও বিরসা মুন্ডার অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। তাঁকে জেলে নৃশংস বা অন্তহীন প্রতারণা দেওয়া হতে লাগলো, কিন্তু তাও উনি ভেঙে পড়েননি। বিচারের প্রহসনে ভয়ানক বিশাসঘাতকতা চলাকালীন আজকের দিনে অর্থাৎ ৯ জুন ১৯০০ সালে রাঁচি কারাগারে জনগণের ভগবান বিরসা মুন্ডাকে ফাঁসি দেওয়া হল।